নিজস্ব প্রতিনিধি: ভূমিহীন স্বামীহারা জরিনা খাতুনের সুখের দিন মাত্র শুরু হয়েছে। ছেলেরা বড় হয়েছে। আজন্ম কষ্ট করা মায়ের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টার কমতি নেই তাদের। মায়ের জন্য ঘরে টিভি ফ্রিজসহ যাবতীয় ব্যবস্থাই ছেলেরা করছেন। কারণ চিরটাকাল মা তাদের জন্য কলুর বলদের মত শুধু খেটেই গেছেন।বয়সের ভারে নুয়ে পড়া জরিনার ছেলে সন্তান নাতি-নাতনি নিয়ে সুখেই দিন কাটছিল। কিন্তু সেই সুখ কাল হয়ে দাঁড়ালো নদী খনন করার ফলে। সম্প্রতি দাগনভূঞা উপজেলার সিন্দুরপুর ইউনিয়নের গৌতমখালি গ্রামে ছোট ফেনী নদী খনন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। নদী খননের সময় সেখানকার গুচ্ছগ্রামে ছোট ফেনীর নদীর তীরে জরিনার তিলে তিলে গড়ে তোলা ৩০ বছরের সাজানো স্বপ্ন মুহূর্তেই চুরমার করে দেয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।তার বসতবাড়ী, ভিটেমাটি ঘর সবকিছু মুহূর্তেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয় দানব স্কেভেটর। অসহায় বৃদ্ধা জরিনা বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও স্কেভেটরের নিচে চাপা দেয়ার হুমকি দেয় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন। এখন সর্বস্ব হারিয়ে পথে-ঘাটে দিনাতিপাত করছেন জরিনা।ভূমিহীন জরিনা খাতুন তিন দশক আগে স্বামীকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী কৌশল্যা গ্রাম থেকে দাগনভূঞার সিন্দুরপুর ইউনিয়নের গৌতমখালি গ্রামে এসে বসত গড়ে নদীর পাড়ে। ঝড়-বৃষ্টি নদীর সাথে যুদ্ধ করে ভূমিহীন হিসেবে বরাদ্দকৃত ১৫ শতক জমিতে ত্রিশ দশকে তিলে তিলে গড়ে তুলেন আপন স্বপ্নের বসতবাড়ি।সেই বাড়িতে জন্ম নেয় তার পাঁচ সন্তান। বসতভিটা থাকলেও ছিলনা সেখানে পৌঁছানোর রাস্তা। কাঁদা-জলে একাকার হয়ে বর্ষাকালে থাকতে হতো তাদের। একদিকে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বসতভিটা টিকিয়ে রাখা, আর অন্যদিকে সন্তানদের লালন-পালন করার জন্যে চরম সংগ্রাম করতে হয়েছে জরিনা আর তার স্বামী আব্দুর রবকে। সন্তানের মতোই আপন মমতায় গাছগাছালিও বড় করেন নিজ বসতভিটায়। বর্তমানে মাঠে-ঘাটে রোদ-বৃষ্টিতে দিনাতিপাত করছেন তারা। এমন পরিনতি শুধু জরিনা খাতুনের একার নয় ধন বিয়া, আরাধন, মোমেনা, এবাদুল হক, বাবলু, নুরুল হকসহ নয়টি পরিবারের।গত সোমবার সরেজমিনে গৌতমখালিতে গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদীর তীরে বসে এক সময় যেখানে তাদের বসতভিটা ছিল সেখানে দিশেহারা হয়ে ভাবছেন অনাগত দিনে পরিবার সন্তানের অজানা ভবিষ্যত নিয়ে।নদী খননের ফলে একসময় এখানে নয়টি পরিবার বসত করতো এমন কোনো চিহ্নই নেই নদীর তীরে। পুরোপুরি নয়টি পরিবারকেই নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। উচ্ছেদের চিহ্ন কিছুটা চোখে পড়ে পাশ্ববর্তী ফসলি জমির মাঠে পড়ে আছে কিছু কেটে ফেলা গাছ এবং উপড়ে ফেলা ঘরের ধ্বংসাবশেষ। কেউ কেউ ভাঙ্গা টিন-ভেড়া সরাতে পারলেও মাটি চাপা পড়ে যায় ওবায়দুল হকের পুরো ঘরবাড়ী।বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি পরিবারেই আট-দশজন করে সদস্য রয়েছে। ভিটেমাটি হারিয়ে তারা এখন খোলা আকাশের নিচে অথবা আশ পাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। এত কিছুর পরেও মিলেনি কোন সরকারি সাহায্য। পাননি কোনো বসতবাড়ি ফিরে পাওয়ার আশ্বাসও।বরং তাদের উচ্ছেদের পর আশপাশের ভূমির মালিকরা তাদের বসতভিটায় নিজেদের জমি দাবী করে খুঁটি গেড়ে দিয়েছেন। তাদের দাবি খাসের জায়গা যেহেতু তাদের ভূমির পাশে সুতরাং এই জারগার মালিক তারাই। এই পরিস্থিতিতে পরিবারগুলো কোথায় যাবে এই ভেবেই দিশেহারা।গৃহহীন এবাদুল হক জানান, ১৯৯১ সালের বন্যার পর দাগনভূঞার নারায়নপুর থেকে পরিবার নিয়ে চলে আসেন এই নদীর তীরে। যেখানে মানুষতো দূরের কথা গরু-ছাগলের বসবাস করার যোগ্য ছিল না। সেখানে জল কাঁদায় সাপ আর বিচ্ছুর সাথে বসতি গড়ে তোলেন তারা। ১৯৮৯ সালে গৃহহীনদের জন্য তৈরি করা এই গুচ্ছগ্রামে তার নামে বরাদ্দকৃত ১৫ শতাংশ ভূমিতে তিলে তিলে গড়ে তোলেন নিজের আবাসভূমি। কখনোই ভাবেনি মুহুর্তেই তার এই স্বপ্নের আবাসভূমি পরিণত হবে চারণভূমিতে। তিনি আরো জানান, এখন তার হাতে কেবল ভূমির বন্দোবস্তের কাগজটি অবশিষ্ট আছে।অপর গৃহহীন ধনবিয়া জানান, আমাদেরকে সরকার জায়গা দিয়েছে, সেই জায়গায় ভিক্ষা করে তিলে তিলে মাথা গোঁজার ঠাঁই গড়েছি। এখান থেকে আমাদের উচ্ছেদ করে দিয়েছে আমরা কোথায় যাব, কার কাছে যাবো।একই কথা বলছেন জীবন যুদ্ধে স্বামীহারা জরিনা খাতুন। তিনি বলেন স্বামী দিনমজুরি করে আর আমি ভিক্ষে করে এই বসতভিটা করেছি। গৌতমখালির মানুষ আমাদেও তিন বার উচ্ছেদ করতে চেয়েছে। অনেক মামলা হামলা করে টিকে ছিলাম। বছরের পর বছর স্বামী স্ত্রী মিলে মাটি কেটে ভিটা বেধেছি। স্বামী অসুস্থ হয়ে মরেও গেছে। ছেলে সংসার নিয়ে যখন সুখের মুখ দেখতে শুরু করেছি তখনই আমাদের সব স্বপ্ন চুরমার করে দিল এই নদী খনন।তিনি জানান, নদী খননের সময় উপজেলা প্রশাসন ও ভূমি কর্মকর্তারা জানিয়েছে সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। তাদের দাবি সরকার কোন প্রকার নোটিশ এবং ক্ষতিপূরণ না দিয়ে তাদেরকে অমানবিক ভিোব কেন উচ্ছেদ করলো। সামনে আসছে বর্ষা। এসময় মানুষ কুকুর বিড়ালকেও আশ্রয়হীন করেনা।অপর বসতভিটা হারানো মোমেনা খাতুন জানান, সারাদেশে দেখছি সরকার গৃহহীনদের গৃহের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। আর এখানে সরকারের দোহাই দিয়ে আমাদেরকে গৃহহীন করে দিয়েছে আমরা কার কাছে যাব। জেলা প্রশাসক,ফেনী-আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে তারা তাদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবী জানান।এই বিষয়ে ঠিকাদার সালেহ বাবুল জানান, মরা নদী পুনঃখননের জন্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। এ সময় বলা হয়েছে সরকার ব্যাক্তি মালিকানাধীন জমির ক্ষতিপূরণ দিয়ে তা অধিগ্রহণ করবে, সরকার মালিকিয় অথবা খাস জমিতে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ বা অধিগ্রহণ করার প্রয়োজন নাই তাই। তারা বসতবাড়ি উচ্ছেদ করেছেন।এই বিষয়েই পানি উন্নয়ন বোর্ড’র কর্মকর্তা আখতারুজ্জামান জানান, নদী কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নদী পুনরুদ্ধারে জন্য সকল বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়েছে। তবে নয়টি পরিবারের উচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন আমরা ঠিকাদারকে তাদেরকে উচ্ছেদ করতে বলিনি।দাগনভূঞা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাহিদা আক্তার তানিয়া জানান, তাদের উচ্ছেদের বিষয় শুনে সরেজমিনে পরিদর্শন করে এসেছি। আসলে তারা আগে যেখানে বসবাস করত নদীর ম্যাপ অনুযায়ী সেটা নদীর জায়গা।
শর্ত পূরণ না করায় ফেনীর ৯...
ফেনীর মেধাবী মুখ রিয়ার এড...
চৌদ্দগ্রামে জুয়া খেলার সর...
ছাগলনাইয়ায় অবহেলিত মানু...
Subscribe to our mailing list to get the new updates!