নজরুল বিন মাহমুদুল: দিনটি ছিল শনিবার (৪ জুন)। রাত তখন ৯ টা বেজে ২০ মিনিট। হঠাৎ ৯৯৯ থেকে সংবাদ আসলো চট্টগ্রামের বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নি নির্বাপনের জন্য সেখানে ছুটে গেলেন পাশ^বর্তী কুমিরা ও সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন। তারা আগুনের কাছাকাছি গিয়ে অগ্নি নির্বাপনে যখন সচেষ্ঠ তখন অজানা এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলো বিএম ডিপো এবং আশপাশের ঘরবাড়ি। এতে বাড়িঘরগুলোর দরজা জানালা ভেঙ্গে যায়। কিসের বিস্ফোরণ কেউ জানেনা। আতংকে কাঁপছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বিএম ডিপো।
ফায়ার সার্ভিসের ১ম ও ২য় টিম যারা গেলেন তাদের গাড়ী বিস্ফোরিত হয়ে কেউ বাহিরে আর ফেরত আসতে পারলেন না। আতংক ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশে। বিশে^র আনাচে কানাচে সবার দৃষ্টি, সবার কান বাংলাদেশে কি হচ্ছে ?এরই মধ্যে রাত ১১ টায় ঢাকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ থেকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর’র মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাইন উদ্দিন, বিএসপি, এনডিসি, পিএসসি, জি, এমফিল অগ্নি নির্বাপনে যাওয়ার জন্য সংবাদ দিলেন অগ্নি দুর্ঘটনায় মোকাবেলায় অভিজ্ঞ ফায়ার ফাইটার ফেনীর উপ-সহকারী উপ-পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসু্িদ্দকে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ফেনী জেলার ফেনী ফায়ার স্টেশন’র সিনিয়র স্টেশন অফিসার জাকের হোসেন’র নেতৃত্বে এবং ফুলগাজী ফায়ার স্টেশন’র ওয়্যার হাউস ইন্সপেক্টর ওয়াসির নেতৃত্বে একটি এ্যাম্বুলেন্সসহ তিনিট টিম নিয়ে রওয়ানা দিলেন সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর উদ্দেশ্যে। বরাবরে অগ্রভাগে ছিলেন ডিআইডি পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দি। তিনি সবসময় আগুন এবং দুর্ঘটনায় মোকাবেলায় নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে কাজ করে যান নিরলসভাবে।
আমরা দেখেছি তিনি ফেনী ডিসি অফিসের পাশে একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডে, একাধিক ভবনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আমরা দেখেছি ফেনী পুলিশ কোয়ার্টার এলাকার একটি ভবনে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আহতদের উদ্ধার করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এছাড়াও ফেনীর স্টার লাইন ফুড ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ডিআইডি পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দির ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ইতোমধ্যে বিএম ডিপোতে কনটেইনার বিস্ফোরণে লন্ডবন্ড হয়ে যায় ডিপোর অভ্যন্তর ও আশপাাশের এলাকা। চারদিকে অজানা আতংকের মাঝে প্রশাসন যন্ত্র স্থবির হয়ে পড়েছে। যারা অসহায় মানুষের পাশে দুর্যোগে দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাড়ায় তাদের যদি দুর্ঘটনায় কেমন হতে পারে সাধারণ মানুষ কেমন হতে পারে ? প্রশাসন যন্ত্র কেমন হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। বিএম ডিপোতে ফায়ার ফাইটার ও স্বেচ্ছাসেবকদের মৃত্যুতে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। ২৫ টি ফায়ার স্টেশন’র ৩৬ টি টিমের মধ্যে একটি ছিল ফেনীর টিম। মুহমুহ বিস্ফোরণে বিএম ডিপোতে যখন কেউ ভিতরে প্রবেশ করতে ভয় পাচ্ছে ঠিক তখনই কান্ডারীর ভূমিকায় ডিআইডি পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি। মুখে ভিজা গামছা ও হিট প্রটেক্টিব সু’ পরে ভিতরে প্রবেশ করলেন দেখলেন, পর্যবেক্ষণ করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন। নাহ! এভাবে বসে থাকা যায় না। শুরু করতে হবে অপারেশন। ফেনী থেকে ৩ টি টিম নিয়ে আসা টিমের সদস্যদের সাথে তিনি কথা বললেন। না আমরা বসে থাকতে পারিনা। এমন দুর্যোগের মুহুর্তে ডিআইডি পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দির নির্দেশে ফেনীর ফায়ার ফাইটাররা একে একে ভিতরে প্রবেশ করলো। শুরু হলো অগ্নি নির্বাপনের অঘোষিত যুদ্ধ।এমনই এক বিপদসংকুল পরিবেশে যখন বাহিরে আতংক বিরাজ করছে তখন ফেনীর টিম ভিতরে কাজ করছে দক্ষিণ পূর্ব কোণায়। যাতে করে আগুন নতুন করে কনটেইনারে আর ছড়াতে না পারে। জীবন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ফায়ার ফাইটারগণ সাথে আছেন পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি।উৎসক জনতার উপস্থিতির সাথে বিএম ডিপোতে অনেক স্বেচ্ছাসেবী পাশ^বর্তী বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা থেকে ত্রাণ নিয়ে আসে। একদিকে মানুষ কাতরাচ্ছে অন্যদিকে ফায়ার ফাইটার ও স্বেচ্ছাসেবীরা মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।এরই মধ্যে বিএম ডিপোতে একে একে কালুরঘাট, খাগড়াছড়ি, বায়েজিদ ও বান্দরবান’র ফায়ার স্টেশন এসে পৌঁছে। শুরু হলো সম্মিলিত যুদ্ধ। ধীরে ধীরে বিএম ডিপোর আগুন পরাস্ত হতে শুরু করলো।
পরের দিন রবিবার সকালে সূর্য উঠার আগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর’র মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ মাইন উদ্দিন, বিএসপি, এনডিসি, পিএসসি, জি, এমফিল উপস্থিত হলেন। বদলে গেল অগ্নি নির্বাপন অভিযানের চিত্র। বিএম ডিপোর অপারেশনের দায়িত্ব দিলেন কুমিল্লা ফায়ার স্টেশন’র সহকারী পরিচালক আকতারকে। সার্বক্ষণিক সাহায্যের জন্য ফেনীর উপ-সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দিকে দায়িত্ব দেওয়া হলো। বিএম ডিপোর আগুন যাতে নতুন করে আর ছড়াতে না পারে। উভয় কর্মকর্তার সম্মিলত প্রচেষ্টা ও ফায়ার ফাইটারদের আপ্রাণ চেষ্টায় বেকেট করা হলো বিএম ডিপোর আগুন। ফায়ার সার্ভিস’র মহাপরিচালক কথা বললেন, সেনা প্রধানের সাথে এবং সাহায্য চাইলেন। কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বদলে গেল অপারেশনের রুপ। বিএম ডিপোতে এলেন সেনা প্রধান, ফোর্ট চেয়ারম্যান, তথ্য মন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, শিক্ষা উপ-মন্ত্রীসহ স্থানীয় এমপি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। এরপর পুলিশ প্রধানসহ আরো অনেকেই এলেন। গঠিত হলো তদন্ত টিম। আগুন তখনও জ¦লছে, চলছে নির্বাপনের চেষ্টা। একে একে জাতি হারালো ৪৯ সন্তানকে বাংলাদেশ হারালো ১৩ জন অগ্নিযোদ্ধাকে। সোমবার রাতে অগ্নি নির্বাপনের সমাপ্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিএম ডিপো ট্র্যাজেডির পরিসমাপ্তি ঘটে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ফেনীর উপ-সহকারী পরিচালক পূর্ণ চন্দ্র মুৎসুদ্দি দৈনিক স্টার লাইনকে জানান, আমার দীর্ঘ কর্মময় জীবনে সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর আগে অনেক অগ্নিকাণ্ড মোকাবেলা করলেও এটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ট্র্যাজেডিতে আমরা ১৩ জন অগ্নি যোদ্ধাকে হারিয়েছে। যাদের প্রাণের বিনিময়ে দেশের সম্পদ রক্ষা করা হয়েছে। আমি শুধু আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। দিকনির্দেশনা দিয়েছি কখন, কিভাবে কাজ করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবশেষে আমরা বিএম ডিপোর অগ্নি নির্বাপনের সমাপ্তি ঘোষণা করতে সক্ষম হই। বিএম ট্র্যাজেডিতে যারা শহীদ হয়েছেন জাতি তাদের আজীবন কৃতজ্ঞচিত্রে স্মরণ করবে।
শর্ত পূরণ না করায় ফেনীর ৯...
ফেনীর মেধাবী মুখ রিয়ার এড...
চৌদ্দগ্রামে জুয়া খেলার সর...
ছাগলনাইয়ায় অবহেলিত মানু...
Subscribe to our mailing list to get the new updates!