নুর উল্লাহ কায়সার: ফেনীতে একেরপর এক বন্ধ হচ্ছে সিনেমা হল। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, দীর্ঘদিন ভালো ছবি তৈরী না হওয়া, দর্শক কমে যাওয়ায় টানা লোকসানে এসব সিনেমা হল ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে ঘরে বসে স্যাটেলাইট টিভির বিস্তার আর ভিডিও পাইরেসির কারণে সিনেমা হলের কদর কমছে বলে মনে করছেন ফেনীর হল মালিকরা। পাশাপাশি সিনেমা হলে আধুনিক পরিবেশ নিশ্চিত না করতে পারাটাও একটি বড় সমস্যা বলে মনে করছেন দর্শকরা। এক সময়ে ফেনীতে সিনেমা হলের ব্যবসায় জৌলুস থাকলেও এখন সব শেষ হয়ে গেছে। ফেনীতে ৬টি সিনেমা হলের এখনমাত্র দুলাল সিনেমা হলটি চালু আছে। সেটিও বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা এসেছে মালিক পক্ষ থেকে। এতে করে ফেনীতে সিনেমা হলে ছবি দেখার সংস্কৃতি মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তবে ভালো ছবি নির্মাণ, বলিউড ছবি আমদানী, হলের পরিবেশ আধুনিকায়ন ও পরিবার নির্ভর ছবি থাকলে পূনরায় দর্শকদেরকে হল মুখি করা যেতে পারে বলে মনে করেছেন স্থানীয়রা। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক সময়ে ফেনী জেলা শহরে দুলাল, সুরত, বিলাসী ও কানন সিনেমা হল নামের ৪টি হল ছিলো। এছাড়াও ফুলগাজীতে বিউটি ও দাগনভূঞায় ঝর্ণা সিনেমা হল চালু ছিলো। এসব সিনেমা হলে ছবি দেখার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শক ভিড় জমাতেন। বিনোদনের অন্য কোন ব্যবস্থা না থাকায় তৎকালীন সময়ে সিনেমাকেই প্রধান নিয়ামক বলে মনে করা হতো। ভালো কোন ছবি মুক্তি পেলে গ্রামগঞ্জ ও দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ বাস রিজার্ভ করে সিনেমা হলে প্রবেশ করতো। তখন পিকনিক স্পর্টের মত অনেকেই আগে বুকিং দিয়ে টিকেট নিয়ে যেতো। দর্শনার্থীদের চাপ সামলাতে আইনশৃংখলা বাহিনী সবসময় তৎপর ভূমিকায় থাকতো। কানন সিনেমা হলের নিয়মিত দর্শক তারা বাবু, একসময় সপ্তাহে ৩/৪ দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সিনেমা দেখতাম। আমি বিগত ১০ বছরেও সিনেমা হলে যাইনি। এজন্য শুধু আকাশ সংস্কৃতি ও ইউটিউবকে দোষারোপ করে লাভ কি। দর্শকরা এখন ভালো ছবির পাশাপাশি ভালো পরিবেশ চায়। টানা তিনঘন্টা বসে বিনোদন করার জন্য আধুনিক আসবাবপত্র ও আসন চায়। ফেনীর কোন সিনেমা হলেই তা ছিলো না। হলে ভালো ছবি না থাকায় দর্শক নেই। আয় কমে যাওয়ায় হলের মালিকরাও পরিবেশ সংস্কারে উদাসীন। ফেনীর সিনেমা হল মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৫২ সালের দিকে ক্রীড়া সংগঠক খায়রুল এছাক মিয়া ফেনীর ফেনীর রেল স্টেশন সড়কে দুলাল সিনেমা হল চালু করেন। এর বছরখানেক পর শহরের জিরো পয়েন্ট সংলগ্ন সমবায় সুপার মার্কেটে সুরত সিনেমা হল চালু করে আফজালুর রহমান। ১৯৭৮ সালের দিকে আবুল কালাম আজাদ পেয়ারা ও মমতাজুল হক ভূঞার হাত ধরে শহরের মাস্টারপাড়া মোড়ে শুরু হয় কানন সিনেমা হল। ১৮৮০ সালের পরবর্তী সময়ে নুর মিয়া শহরের একাডেমী রোডে চালু করেন বিলাসী সিনেমা হল নামের আরো একটি সিনেমা হল। বিনোদনের জন্য নিরাপত্তা, পরিবেশ ও আসন ভালো থাকায় সুরত সিনেমা হল ও দুলাল সিনেমা হলই দর্শকদের পছন্দের তালিকায় ছিলো। এসব হলে প্রতি শো’তে ৭০০ থেকে ৮০০ জনের টিকেট বিক্রি হতো। অন্য সিনেমা হল গুলোতে ভালো ছবি না চললে দর্শক সমাগম কিছুটা কম হতো। সেখানেও প্রতি শো’তে ৪০০ থেকে ৬০০ দর্শকের সমাগম ঘটতো। শহরের ৪ টি সিনেমা হলে প্রতিদিন অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার দর্শক বিনোদন করতো। গত দুই দশকে দেশে ইন্টারনেটের সহজ ব্যবহার সাধারণ মানুষকে বিনোদনের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। একই সময়ে ডিস ব্যবসার প্রসার হওয়ায় মানুষের ঘরে ঘরে সিনেমা পৌছে গেছে। তাছাড়াও ক্রমাগত লোকসানে বিনিয়োগকারী, নির্মাতা ও প্রযোজকরা ছবি তৈরীতে বাজেট কমিয়ে আনায় উল্লেখযোগ্য ভালো ছবি তেমন হয়নি। এছাড়াও হলের ভেতর ও বাহিরের পরিবেশে তেমন কোন আভিজাত্য ও আধুনিকতা আসেনি। এ কারণে দর্শকরা সিনেমা হলে ছবি দেখা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। গত দুই দশকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, চলচ্চিত্রে দক্ষ ও ভালো অভিনেতা তৈরী না হওয়ায় বড় পর্দায় সিনেমার প্রতি দর্শকের আগ্রহ কমে যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৩ সালের দিকে ফেনীর জনপ্রিয় হল সুরত মহলের মালিক আফজালুর রহমান মারা যাওয়ার পর তার ছেলে বাচ্চু মিয়া সিনেমা হলটির দায়িত্ব নেন। পরবর্তীতে আরো বেশি আয়ের সুযোগ থাকায় তারা সিনেমা হলটি ভেঙ্গে দোকানঘর করে ভাড়া দেন। একাডেমী রোডের বিলাসী সিনেমা হলটির প্রতিষ্ঠাতা নুর মিয়া মারা যাওয়ার পর তার ছেলেরা তৎকালীন প্রভাবশালী কমিশনার ওমর ফারুকের কাছে ভাড়া দিয়ে দেন। একপর্যায়ে ভালো ছবি না পাওয়ায় দর্শক কমতে থাকে। লোকসানের ভয়ে ২০০২ সালের দিকে সিনেমা হলটি তিনি ছেড়ে দিলে আর কেউ চালু করতে এগিয়ে আসেনি। এদিকে শহরের কানন সিনেমা হলটি গত বছরে করোনা পরিস্থিতির আগ পর্যন্ত চালু ছিলো। গত কয়েকবছর যাবত এ সিনেমা হল থেকে লাভ না পেলেও ৫/৭ জন কর্মচারীর পরিবার চলতো বলে মালিকপক্ষ এটি বন্ধ করেননি। তবে করোনা পরিস্থিতিতে কয়েকমাস বন্ধ থাকায় কর্মচারীরা অন্য পেশায় চলে গেলে তারা সিনেমা হলটি ভেঙ্গে বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করেন। দুলাল সিনেমা হলে গিয়ে দেখা যায় সেখানে ‘কাউন্টার এ্যাটাক’ নামের একটি পুরাণ ছবি চালানো হচ্ছে। পুরো হল জুড়ে মাত্র ১০/১২ জন দর্শক রয়েছে। কেবিনের টিকেট কিনে ঘুমিয়ে আছেন এক দর্শক। নিয়মিত দর্শক না থাকায় ফাঁকা আসনগুলো ধুলোবালিতে ঢাকা পড়ে আছে। কিছুকিছু আসন ভেঙ্গে গেলেও সংস্কার করা হচ্ছেনা দীর্ঘদিন ধরে।হলের ক্যাশিয়ার গোলাম নবী জানান, দুলাল সিনেমা হলে এক সময় ৫টি শো’ চালানো হতো। দর্শক না থাকায় এখন ২/৩টি চালানো হয়। হলটিতে ৮টি ভিআইপি সিটে ১০০ টাকা টিকেট, ২০ জনের কেবিন সিটে ৮০ টাকা করে টিকেট, ৬০ জনের বেলকনিতে ৭০ টাকা করে ও প্রথম শ্রেনীতে ৮০ সিটে ৬০ টাকা করে টিকেট বিক্রি করা হয়। গত কয়েক বছর যাবত ২য় ও ৩য় শ্রেনীর টিকেট বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি জানান, আমি ৩৫ বছর আগে দুলাল সিনেমা হলে ফেরী করতাম। তখন শুধু লজেন্স আর আচার বিক্রি করেই আমার সংসার চলতো। বিশ্বস্ত হওয়ায় একপর্যায়ে মালিক পক্ষ আমাকে হলটিতে নিয়োগ দেয়। দর্শক না থাকায় এখন হলের ক্যাশিয়ারের দায়িত্বে থেকেও সংসার চালানো যাচ্ছেনা। হলের দায়িত্বে পাশাপাশি পান দোকান করে সংসারের ঘøানি টানতে হচ্ছে। নবী আরো জানান, ৯০ এর দশকে ফেনীর হলগুলোতে টিকেটের দাম ছিলো ২ টাকা ২০ পয়সা থেকে সর্বোচ্চ ৫ টাকা। তখন হলগুলোতে দর্শকদের টিকেট কেনার দীর্ঘ সারির কথা এখনো মনে পড়ে। দুলাল সিনেমা হলের বর্তমানে তত্ত্বাবধানে রয়েছেন প্রকৌশলী ইঞ্জিনিয়ার সফিউদ্দিন বেলাল। তার সাথে কথা হয় ফেনীর সিনেমা হলের একাল-সেকাল নিয়ে। তিনি জানান, এক সময়ে সিনেমা দেখার জন্য এলাকার যুবকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাস রিজার্ভ করে আসতো। বিশেষ করে বেদের মেয়ে জোসনা, রূপবানের মত চলচ্চিত্র দেখতে দর্শকদের ভীড় সামাল দিতে আইনশৃংখলা বাহিনীর সহযোগিতা লাগতো। তখন সিনেমা হলের ব্যবসায় আভিজাত্য ছিলো। জৌলুস ছিলো। ভালো ছবিগুলো তিনমাস চালানোর পরও দর্শক কমতোনা। অনেক সময় ছবির মালিকরা এসে জোর করে আমাদের থেকে ছবিগুলো নিয়ে যেতো। বর্তমানে ভালো অভিনেতা নেই, ভালো ছবি নেই, তাই দর্শকও নেই। ফেনীর ঘরে ঘরে এখন ডিস লাইন পৌছে গেছে। এখন মানুষ ঘরে বসে নিজের পছন্দমত ছবি পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখতে পারে। তিনি জানান, তাদের মালিকানায় ফেনী, রামগতি, মাটিরাঙ্গা, লাকসাম, হাতিয়ায় কয়েকটি সিনেমা হল ছিলো। তখন লাভও ভালো হতো। শুধু ফেনীর দুলাল সিনেমা হলে ৩০/৩৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকতো। মূলত ২০১৫ সালের পর থেকেই সিনেমা হলগুলো থেকে দর্শক কমতে থাকে। হলের সিট, নিরাপত্তা পরিবেশের বিষয়ে তিনি বলেন, তখনই এগুলো ঠিক হবে, যখন হলে ভালো ছবি আসবে; দর্শক সমাগম হবে। হলের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য দর্শকের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্মত ও আধুনিক পরিবেশ নিশ্চিত করার উপর জোরদিতে হবে। শুধু দেশীয় চলচ্চিত্র দিয়ে এ মুহূর্তে সিনেমা হল বাঁচিয়ে রাখা যাবেনা। এজন্য ইউটিউবে বলিউডের ছবি বন্ধ করে সিনেমা হলে প্রদর্শন করা হলে দর্শক আবার হল মুখি হতে পারে। মান সম্মত ছবি না পাওয়া গেলে সিনেমা হলের যত উন্নয়নই করা হোকনা কেন, কোনভাবেই সিনেমা হলের ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যাবেনা। সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ফেনীর সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জানান, সিনেমা হলের সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সরকার, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের সাথে হলমালিকরাও দায়ী রয়েছেন। কারণ হলের পরিবেশ ও ভালো ছবি একে অপরের পরিপূরক। তারা দর্শকদের রুচির সাথে তাল মিলিয়ে হলের পরিবেশের উন্নতি ঘটাতে পারেনি। হলের পর্দা ও আসনগুলো যুগোপযোগী ছিলোনা বলে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তাছাড়া কয়েক বছর যাবত পরিবার নির্ভর ছবি তৈরী না হওয়ায় হলে দর্শক আসছেনা। জেলা সম্মিলিত সংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সমরদেব নাথ বলেন, বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব ও ভালো চলচ্চিত্র না হওয়ায় সংস্কৃতিক কার্যক্রম বিলুপ্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সিনেমা হলের সংস্কৃতিতো আরো আগেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে সরকার সিনেমা হল মালিকদেরকে নানা ভাবে প্রণোদনা দিয়ে এ সংস্কৃতিকে ঘুরো দাড়ানোর চেষ্টা করছে। তবে এক্ষেত্রে দেশের সকল জেলায় শিল্পকলা একাডেমী রয়েছে, সেসকল স্থানে সরকারী ভাবে নাম মাত্র ফি দিয়ে সপ্তাহে অথবা মাসের যে কোন দিন ভালো কিছু সিনেমা প্রদর্শন করা যেতে পারে। এতে করে ক্রমেই দর্শকদের মাঝে সিনেমা প্রীতি সৃষ্টি হবে। শুধু বেসরকারী নয়; বরং সরকারী ভাবে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় কম মূল্যে সিনেমা প্রদর্শনের দাবী জানান এ সংস্কৃতিক সংগঠক। ফেনী জেলা কালচারাল অফিসার জান্নাত আরা যুথি জানান, সংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য ফেনী একটি উর্বর স্থান। এখানে সিনেমা হলের সংস্কৃতি বিলুপ্তি হওয়ার বিষয়টি অপ্রত্যাশিত। সরকার এ শিল্পকে রক্ষা ও ঘুরে দাড়ানোর কোন উদ্যোগ নিলে আমরা সংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠনগুলো সব ধরনের সহযোগিতা করবো। জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুজ্জামান জানান, সরকার সিনেমা হলের সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে নানামূখী উদ্যোগ নিয়েছে। এক্ষেত্রে ফেনীতে কোন উদ্যোক্তা অথবা যে কোন ব্যক্তি এগিয়ে এলে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা হবে।
শর্ত পূরণ না করায় ফেনীর ৯...
ফেনীর মেধাবী মুখ রিয়ার এড...
চৌদ্দগ্রামে জুয়া খেলার সর...
ছাগলনাইয়ায় অবহেলিত মানু...
Subscribe to our mailing list to get the new updates!