নুর উল্লাহ কায়সার: ফেনীর সোনাগাজী ইসলামীয়া দাখিল মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফী হত্যা মামলার রায় ঘোষণার দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধিন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল মারা যায় প্রতিবাদী নুসরাত। এ ঘটনায় ২৪ অক্টোবর ফেনীতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ বহুল আলোচিত এ মামলায় অভিযুক্ত ১৬ আসামীর মৃত্যুদন্ড ও ১ লাখ টাকা করে জরিমানার আদেশ দেন। রায় প্রকাশের পর তা কার্যকরের জন্য ডেথ রেফারেন্স উচ্চ আদালতে শুনানীর জন্য নথিভূক্ত হলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তা আটকা পড়ে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ডেথ রেফারেন্সের শুনানী শেষ করে রায় কার্যকর চান নুসরাতের পরিবার, স্বজন ও সহপাঠীরা। জানা যায়, সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর অভিযোগ প্রত্যাহার না করায় বিগত ২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে ছাদে ডেকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে নুসরাতকে হত্যার চেষ্টা করে তার সহপাঠীরা। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে চিকিৎসাধিন অবস্থায় ৯ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পরই ঘটনাটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশী গণমাধ্যমেও সমালোচনার ঝড় তোলে। ঘটনাটি জড়িতদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবীতে রাস্তায় নেমে আসে আন্দোলনকারীরা। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। অপরদিকে শ্লীলতাহানীর ঘটনায় তাকে থানায় ঢেকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও ধারণ করে তা প্রচারের ঘটনায় ব্যারিস্টার ছায়েদুল হক সুমন আইসিটি আইনে আরো একটি মামলা দায়ের করেন। নুসরাতের পরিবারের সদস্য, পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২৭শে সোনাগাজী ইসলামীয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা কর্তৃক যৌন নিপিড়নের শিকার হন নুসরাত জাহান রাফি। ওই ঘটনায় তার মা বাদি হয়ে অধ্যক্ষ সিরাজকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেন। একই দিনই পুলিশ সিরাজকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। ওই মামলা তুলে নিতে অধ্যক্ষের অনুসারী ও সহপাঠীরানুসরাত ও তার পরিবারের সদস্যদের চাপ দিতে থাকে। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল খুনিরা সিরাজের সঙ্গে কারাগারে পরামর্শ করে এসে ৪ এপ্রিল মাদ্রাসার ছাত্রাবাসে নুসরাতকে খুন করার পরিকল্পনা নেয়। ৬ এপ্রিল নুসরাত আলীম পরীক্ষা দিতে এলে সহপাঠিরা সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নিয়ে তার গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে হত্যার চেষ্টা চালায়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে নুসরাতকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল ও অবস্থার অবনতি হলে নুসরাতকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ এপ্রিল রাতে মারা যান নুসরাত। এ ঘটনায় নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান ৮ এপ্রিল সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটির প্রয়োজনীয় তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশান (পিবিআই) ১৬ জন আসামীকে অভিযুক্ত করে চার্জশীট প্রদান করেন। ২০ জুন অভিযোগ গঠন করেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। পরে ৬১ কার্য দিবসের মধ্যে ৮৭ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহন শেষে ২৪ অক্টোবর রায় ঘোষণাকালে সকল আসামীর ফাঁসির দন্ডাদেশ দেন বিচারক মামুনুর রশীদ। পাশাপাশি প্রত্যেক আসামিকে একলাখ টাকা করে জরিমানা দন্ডেও দন্ডিত করেন।সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রুহুল আমিন (৫৫), স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মাকসুদ আলম (৫০), মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), প্রভাষক নুরুল আফসার (৩৩), মাদ্রাসার ছাত্র নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), সাইফুর রহমান মো. যুবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন (১৯), আবদুর রহীম শরিফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০), মহিউদ্দিন শাকিল (২০), মাদ্রাসার ছাত্রী কামরুন নাহার মনি (১৯) ও উম্মে সুলতানা পপি (১৯)। নি¤œ আদালতে রায়ের পর প্রধান আসামী অধ্যক্ষ সিরাজ, নুর উদ্দিন, জাবেদ হোসাইন ও উম্মে সুলতানা পপি খালাস চেয়ে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। এখন আপিল শুনানীর অপেক্ষায় রয়েছে।এদিকে নুসরাতের ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগে ২০১৯ সালের ১৫ এপ্রিল তৎকালীন সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন ব্যারিস্টার ছায়েদুল হক সুমন। মামলাটি তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ২৭ মে মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দিলে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা দেন আদালত। ১৬ জুন রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে ওসি মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ১৭ জুলাই অভিযোগ গঠন শেষে ৩১ জুলাই থেকে এ মামলায় স্বাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০ নভেম্বর উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে আদালত ২৮ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেনবিচারক মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন। রায়ে ওসি মোয়াজ্জেমের ৮ বছরের জেল ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে ট্রাইব্যুনাল। এটি বাংলাদেশের প্রথম সাইবার ট্রাইব্যুনালের প্রকাশিত রায়। মামলার বাদি নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান জানান, আমরা বিচারিক আদালতে ন্যায় বিচার পেয়েছি। রায় দ্রুত কার্যকরের মাধ্যমে নুসরাতের আত্মা শান্তি পাবে। ঘাপটি মেরে থাকা অপরাধিদের জন্য এটি হবে একটি নিদর্শন। রায় কার্যকর বিলম্বিত হওয়া অপ্রত্যাশিত। জরুরী ভিত্তিতে উচ্চ আদালতের আপিল শুনানী শেষে দ্রুত সাজা কার্যকরের দাবী নুসরাতের বড় ভাই নোমানের।
আগামী বছর ফাঁসির রায় কার্যকর হতে পারে -এড. শাহজাহান সাজু :নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী এম. শাহজাহান সাজু জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ২৯ অক্টোবর আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় কার্যক্রম হাইকোর্টে পৌঁছেছে। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হলে তা অনুমোদনের জন্য মামলার যাবতীয় নথি উচ্চ আদালতে প্রেরণ করা হয়। সে অনুসারে ডেথ রেফারেন্স শুনানীর জন্য উচ্চ আদালতে পৌঁছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উত্থাপন করা হয়। আপিল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠন করেছেন প্রধান বিচারপতি। বিচারপতি হাসান ইমাম ও সৌমেন্দ্র সরকারের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে এ মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আশা করি আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে দন্ডিত আসামীদের ফাঁসির ডেথ রেফারেন্স শুনানীর পর মামলার যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে রায় কার্যকর করা হবে।
শর্ত পূরণ না করায় ফেনীর ৯...
ফেনীর মেধাবী মুখ রিয়ার এড...
চৌদ্দগ্রামে জুয়া খেলার সর...
ছাগলনাইয়ায় অবহেলিত মানু...
Subscribe to our mailing list to get the new updates!