০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ || ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১
বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ফেনীর ট্রমা সেন্টার ১৬ বছরেও চালু না হওয়ায়  জনমনে অসন্তোষ
  • Updated Sep 12 2023
  • / 174 Read


নুর উল্লাহ কায়সার:  
সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রীদের তাৎক্ষণিক সেবা দিতে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে ফেনীর মহিপালে আধুনিক ট্রমা সেন্টার নির্মাণ করে সরকার। তবে নির্মাণের দীর্ঘ ১৬ বছরেও চালু হয়নি বিশেষায়িত হাসপাতালটি। পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে অধিকাংশ যন্ত্রপাতি ও শয্যা। স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেন্টারটিতে বহির্বিভাগ চালু করা হলেও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা না মেলায় কোনো রোগী আসে না এখানে। কাজ না থাকায় গল্প-আড্ডাতেই সময় পার করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ও নার্সরা। অনেকে আবার কর্মস্থলেই আসেন না প্রায় সময়। ফলে যে উদ্দেশ্য নিয়ে ট্রমা সেন্টারটি নির্মাণ হয়েছে তা ভেস্তে যেতে বসেছে।    
ফেনী সদর আসনের সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী বলেন, ‘ট্রমা সেন্টারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। এটি চালু করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত মানুষ খুবই উপকৃত হতো। তবে এখানে লোকবলের সংকট আছে, আছে বাজেটেরও ঘাটতি। সব মিলিয়ে এখানে বেশকিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা চাই স্বল্প সময়ের মধ্যে সমস্যাগুলোর সমাধান করতে। এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাও বলেছি।’
জানা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে ২০০৪ সালে দেশজুড়ে সড়ক ও মহাসড়কের পাশে ১০টি ট্রমা সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে ফেনীর মহিপাল, ফরিদপুরের ভাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জের মাওয়া, সাভারের ধামরাই, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা, চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, কুমিল্লার পদুয়া, হবিগঞ্জের বাহুবল, ময়মনসিংহের ভালুকা ও ঝিনাইদহে বিশেষ এ চিকিৎসালয় নির্মাণে সরকার ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। অবকাঠামো নির্মাণ শেষে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও স্বল্পসংখ্যক জনবল নিয়োগ দেয়া হলেও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কাজেই আসছে না। বরং অযত্ন-অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় এ সম্পদ।
ফেনী স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, ফেনী ট্রমা সেন্টারের তিনতলা ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ২০০২ সালের ৯ মে। প্রায় এক একর জায়গার ওপর ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০ শয্যার হাসপাতালটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০০৬ সালের ৩০ জুলাই। সড়ক ও মহাসড়কে দুর্ঘটনা কবলিত যাত্রীদের তাৎক্ষণিক সেবা দিতে চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোয় সার্বক্ষণিক সাতজন পরামর্শক চিকিৎসক, তিনজন অর্থোপেডিক সার্জন, দুজন করে অ্যানেসথেটিক ও আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা, সিনিয়র স্টাফ নার্স, ফার্মাসিস্ট, রেডিওগ্রাফার, ল্যাব টেকনিশিয়ান, গাড়িচালক, অফিস সহকারী, ওয়ার্ড বয়, আয়া ও ল্যাব অ্যাটেনডেন্টের পদ সৃজন করা হয় প্রতিটি সেন্টারের জন্য। এছাড়া রয়েছে কুক-মশালচি, দারোয়ান, এমএলএসএস ও সুইপারের পদ। কিন্তু ১৬ বছরেও প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দেয়া হয়নি। সম্প্রতি কিছু চিকিৎসক ও নার্স দিয়ে ফেনী ট্রমা সেন্টারে বহির্বিভাগের চিকিৎসা চালু করা হলেও রোগীদের তেমন সাড়া মিলছে না। ঠিকমতো কর্মস্থলে আসেন না দায়িত্বশীলদের অনেকেই। আবার যারা উপস্থিত হচ্ছেন, গল্প-আড্ডা করেই তারা অলস সময় পার করছেন। 
সম্প্রতি ফেনী ট্রমা সেন্টারে সরজমিনে দেখা যায়, তালা লাগানো না থাকলেও বন্ধ রাখা হয় প্রধান ফটক। তাছাড়া আঞ্চলিক মহাসড়ক থেকে অন্তত তিন ফুট উঁচু ড্রেনের স্লাব থেকে লাফিয়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে হয়। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা গেল চারপাশ ঢেকে আছে ঝোপঝাড়ে। কয়েক মিটার পথ হেঁটে তিনতলা সেন্টারটিতে ঢুকতে হয় কলাপসিবল গেট খুলে। নিচতলার সব কক্ষই তালাবদ্ধ। দ্বিতীয় তলায় ভেতরের একটি কক্ষে দেখা মেলে দুজন নার্সের। বহির্বিভাগের রোগীদের ব্যবস্থাপত্র দেয়ার জন্য তারা বসে আছেন। কিন্তু কোনো রোগী নেই। পাশের আরেকটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে একজনের সঙ্গে গল্পে মশগুল মেডিকেল অফিসার ইসমাঈল হোসেন। তৃতীয় তলায় উঠে দেখা গেল ভিন্ন চিত্র। হাসপাতালটি নির্মাণের পর থেকে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা শয্যাগুলো নষ্ট হয়ে গেছে মরিচায়। কভিড কালীন আইসোলেশন ওয়ার্ড তৈরির জন্য পার্টিশন ওয়াল ভাঙা হলেও পরে আর মেরামত করা হয়নি। এমনকি ট্রমা সেন্টারের আইসিইউ, সিসিইউ, এক্স-রে, ইসিজি, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, অপারেশন থিয়েটার, জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির প্রায় সবই নষ্ট। নেই অ্যাম্বুলেন্স ও পানি বরাদ্দ। 
ট্রমা সেন্টারটির মেডিকেল অফিসার ইসমাঈল হোসেনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার এ হাসপাতালে সাতজন নার্স, একজন ফার্মাসিস্ট ও দুজন মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিয়েছে। বর্তমানে কেবল বহির্বিভাগে সেবা দেয়া হয়। সপ্তাহে ছয়দিন সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত রোগীদের ব্যবস্থাপত্র ও বিনামূল্যে কিছু ওষুধ দেয়া হয় বলে জানান ডা. ইসমাঈল হোসেন। দৈনিক ২০-২৫ রোগী হাসপাতালটির বহির্বিভাগে সেবা নেন বলে দায়িত্বশীলরা দাবি করলেও এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। এদিকে নির্মাণের পর এখন পর্যন্ত রোগী ভর্তির কার্যক্রম শুরু না হলেও সাইফুল আলম নামে একজন চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রটিতে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও তাকে হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া যায়নি। 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট একজন জানান, হাসপাতালটিতে কখনো কখনো দু-তিনজন রোগী আসে। তাছাড়া এটি আঘাতজনিত রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র হলেও জ্বর-কাশিসহ ছোটখাটো কয়েকটি সমস্যার ব্যবস্থাপত্র দিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা নেই এ হাসপাতালে। তাই অনেকে চিকিৎসা না নিয়েই চলে যায়। 
সড়ক দুর্ঘটনায় আহতকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছানো না গেলে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কা থাকে বলে জানিয়েছেন ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) মো. আসিফ ইকবাল। তিনি বলেন, ‘ট্রমা সেন্টারটি চালু থাকলে দুর্ঘটনায় আহতদের রক্তক্ষরণ রোধসহ অকাল পঙ্গুত্ব বরণ ও মৃত্যুর হাত থেকে অনেকে রক্ষা পেত। কারণ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থেকে কুমিল্লার আগ পর্যন্ত এবং পার্বত্য খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে আহত রোগীদের ফেনী জেনারেল হাসপাতালে আসতে অনেক সময় লেগে যায়। এতে একদিকে আহতদের যেমন বড় ক্ষতির শঙ্কা বাড়ছে অন্যদিকে জেনারেল হাসপাতালে রোগীর চাপও বাড়ছে। সে কারণেই ফেনী ট্রমা সেন্টারটি মহাসড়কের পাশে নির্মাণ করা হয়েছে। এটি চালু করা হলে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতরা তাৎক্ষণিক সেবা পেত। অনেক বিড়ম্বনাও কমে যেত। রোগীরা সুবিধা পেত।’  

 

ট্রমা সেন্টার চালু হলে হতাহতরা দ্রুত চিকিৎসা পেত
-ওসি, ফাজিলপুর হাইওয়ে
এদিকে সড়কের পাশে নির্মিত ট্রমা সেন্টারটির কার্যক্রম চালু হলে দুর্ঘটনায় আহতদের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমে আসত বলে মনে করেন ফেনীর ফাজিলপুর হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাশেদ খান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ট্রমা সেন্টারটি চালু না হওয়ায় দুর্ঘটনায় আহতদের ফেনী জেনারেল হাসপাতালে পাঠাতে হয়। কিন্তু মহাসড়ক থেকে ফেনী শহরের যানজট পেরিয়ে তারপর হাসপাতালে পৌঁছতে হয়। আবার পথে রেল ক্রসিংয়ে অনেক সময় রোগী বহনকারী পরিবহন আটকা পড়ে। এতে দুর্ঘটনায় আহতদের রক্তক্ষরণসহ গুরুতর নানা সমস্যা দেখা দেয়। অনেক সময় দেরিতে চিকিৎসা পাওয়ার কারণে তারা মারাও যায়।’ 

 

ট্রমা সেন্টারে বহির্বিভাগ চালু আছে
-সিভিল সার্জন

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন সিহাব উদ্দিন বলেন, ‘ফেনী ট্রমা সেন্টারটি চালুর জন্য এখনও পূর্ণাঙ্গ জনবল ও সরঞ্জামাদি পাওয়া যায়নি। বর্তমানে সেখানে বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। তবে পূর্ণাঙ্গভাবে হাসপাতালটি চালু করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।’   

Tags :

Share News

Copy Link

Comments *