আমার দেখা ২৪শে'র ভয়াবহ প্লাবন
- Updated Feb 18 2025
- / 386 Read
ফয়সাল আহাম্মদ
২০২৪ সালের "জুলাই ও আগস্ট" সে যেন এক আতংকের নাম। জুলাই এ ছাত্র-জনতার গনঅভ্যুত্থানে মধ্যে দিয়ে আগষ্টে নতুন এক সূর্যোদয়। বাংলার মানুষ এই নতুন সূর্যোদয় উপভোগ করতে করতে হঠাৎ দরজায় কড়া দিলো প্রবল বর্ষণ ও আন্ত-সীমান্ত নদী বেয়ে আসা উজানের ঢল যা দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অথৈ পানিতে প্লাবিত হয়।
যাই হোক, ভূমিকা উপেক্ষা করে নিজের গল্পে আসি।আমি একজন ক্ষুদ্র পরিবেশ কর্মী। পরিবেশের জন্য কাজ করার পাশাপাশি মানবিক কাজে সদা সজাগ আছি। ফেনীর মানুষ হিসেবে ২৪ শে'র ভয়াবহ বন্যা দেখেছি, খুব কাছ থেকে শুনেছি মানুষের আর্তনাদ।
১৯ আগস্ট বাংলায় ভাদ্র মাস,মধ্যে রাত থেকেই ফেনী জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, চারদিকে ঘন অন্ধকার, আর অথৈ পানি। যেন জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে উপন্যাসের তথাকথিত পরীর দিঘি।
২০ আগষ্ট বন্যার পানি প্লাবিত হচ্ছে, ক্রমেই গিলে পেলছে নতুন স্থল ভূমি,ফসলের ক্ষেত,বসত বাড়ি, আশ্রয় কেন্দ্র কিংবা নিরাপদ জায়গা যাওয়ারও সুযোগ ছিল না,ফলে আটকা পড়ে যায় তাদের নিজস্ব আপন নীড়ে।কত মায়াবী আপন নীড় যেন এক ভয়াবহ ক্ষেত্র।
২১ অগাস্ট একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে আর ঘরে বসে থাকতে পারি নিই। বাতাসে যেন মানুষের আর্তনাদ কানে এসে বাজছে। অনেক কষ্টে চট্টগ্রামের শীতাকুন্ড থেকে মাঝারি সাইজের ট্রাকে ইঞ্জিন চালিত একটি নৌকা নিয়ে আমিসহ আমার পরিবেশ ক্লাবের একটি টিম রওনা হই ফুলগাজি, পরশুরামের দিকে সাথে ছিল কিছু শুকনো খাবার, আর জীবন ধারণের জল। কি আজব তাই না জীবন বাঁচার জল কখনো কখনো হিংস্র হয়ে জীবন কেড়ে নেয় নতুবা দুভােগ সৃষ্টি করে। এরপর ট্রাক থেকে নৌকা নামাই ফুলগাজির বন্দুয়া নামক ফ্রিজের আগে, তখন সন্ধ্যায় ৬টা নাগাদ হতে পারে, কোথাও মাগরিবের আযানও ভেসে আসছে না, আসবে কি করে মসজিদ গুলোতেও অর্থেই পানি। অতঃপর বিসমিল্লাহ বলে প্রথম ধাপে রেসকিউ(উদ্ধারে) রওনা হলাম আনন্দ বাজার, ইসলামপুর, চিতলিয়া, সাতকুচিয়া তথাকথিত এলাকায় গিয়ে দেখি আটকে পড়া মানুষেন আর্তনাদ। যা সত্যিই শব্দ চয়ন সম্ভব নয়! আশ্রিত সবাই চায় বাঁচতে,নৌকায় উঠতে মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ এর সোনার তরী কবিতার লাইনটা-
ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই
ছোট যে মোর তরী
অতঃপর নৌকার ধারণক্ষমতা অনুযায়ী নেওয়ার চেষ্টা করেছি বিশেষ করে গর্ভবর্তী মা, শিশু,নবজাতক, বৃদ্ধ এদের তবে মন চেয়েছিলো যদি সবাই কে একসাথে নিয়ে যেতে পারতাম আসলে সাধ থাকিলেও তখন সত্যিই আমরা ছিলাম নিরুপায়।
২২ অগাস্ট রাত তখন ২টা, গুটগুটে অন্ধকার উপরে কালো আকাশ নিছে অর্থেই পানি নৌকা নিয়ে উদ্ধারের এক পর্যায়ে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ফুলগাজির আনন্দবাজার জায়গায় নৌকায় অতিরিক্ত মানুষ তোলায় নোকাটি তলিয়ে যায়,পরে সবাইকে তীরে নিয়ে আসলে সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধানে চলে আসি চিরচেনা আলোকিত শহর ফেনীতে, এসে দেখি উদ্ধারে যাওয়ার আগে কি রেখে গেলাম আর কি হল রাস্তার দুইপাশে সুউচ্চ দালান আর নিছে গলা সমান পানি শহিদ শহীদুল্লাহ্ সড়কে।আমি ফেনী শহরের পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টারের একটি বিল্ডিং এর নিচ তলায় থাকি,এসে দেখি আমার বাবা-মা অসহায় মত সব গুছিয়ে খাটের একটা কোণে বসে আছে আর নিছে পানি টেউ খেলছে। সব যেন আমার কাছে অবিশ্বাস মনে হল,মনে হল এই বুঝি স্বপ্ন দেখছি দুঃস্বপ্ন চোখ খুললেই মনে হয় সব ঠিক হয়ে যাবে।আসলে শামসুর রহমানে একটা কবিতার লাইন মনে পড়ে গেলো-
"কি সহজে হয়ে গেলো বলা
কাঁপলো নাতো খানিকটা গলা"
বুক চিরে বেরুলো না দীর্ঘশ্বাস
খাতায় দুইচার কলম লেখা আর বাস্তবে উপলব্ধি করা দুইটি ভিন্ন মেরু।
২৩ শে আগষ্ট থেকে থেকে যে সকল স্থানগুলো পানিবদ্ধ ছিল তাদের শুকনা খাবার সরবরাহ এবং রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়ার অপ্রাণ চেষ্টা ছিল আশ্রিত মানুষের কাছে, এই তুচ্ছতম চিড়ামুড়ি যেন এক পূর্ণিমার চাঁদ, বেঁচে থাকার আহা কি সংগ্রাম! আহা কি আকুতি! ২৫শে আগষ্ট এর দিকে যে সকল এলাকা পানি নেমেছে চুলায় আগুন জ্বালানোর উপযোগী ছিল তাদের ভারী খাবার(চাল,ডাল,তেল আলু ইত্যাদি) পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করি।
২৬ আগষ্ট এরপর থেকে যেসকল এলাকায় পানি নেমে যায় ওই সকল এলাকায় অধিকাংশেরই ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে গৃহহীন হয়ে পড়ে রাত কাঁটায় খোলা আকাশের নিচে, তাদের জন্য পুনবাসনের কার্যক্রম পরিচালনার কাজ শুরু করি।
সর্বপরি বলি আমার বয়স সাতাশ এই ছোট জীবনে এমন এক ভয়াবহ ইতিহাসের সাক্ষী হলাম যা কিনা দুইচার কলম লিখলে প্রকাশ করা যায় না।
"আমি চাইনা এমন আর বন্যা,
আমি চাইনা এমন মানুষের আর্তনাদ,
চাইনা হাহাকার "
Share News
-
সর্বশেষ সংবাদ
-
সর্বাধিক পঠিত